শুক্রবার, ১৫ জুন, ২০১২

ছাত্র আন্দোলন ও শিক্ষাঙ্গনে আবারো অশুভ শক্তির আনাগোনা

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল


আবারো নব উদ্যোমে শুরু হলো রক্তের হলিখেলা। রক্তাক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রক্তাক্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাস যেন আজ আবার নতুন করে শিক্ষা নিচ্ছে সময়ের কাছ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক অগ্নিগর্ভ ইতিহাসের সুতিকাগার-কত প্রাণ, কত আত্মত্যাগের মহিমায় গর্বিত এ বিদ্যাপিঠ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পলেস্তরায় লেপ্টে আছে গৌরবের কথককথা। আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে নারকীয়, মধ্যযুগীয় হত্যাযজ্ঞ। যেনো ইতিহাসের ভাষা বদলে আজ নতুন ইতিহাস রচিত হচ্ছে। আর আমরা সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি এই অসহ্য রক্তক্ষরণ। যে বিশ্ববিদ্যালয় আসাদের মৃত্যুতে রণমূর্তী ধারণ করে, আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন আবু বকর লাশ হয়ে বাড়ী ফিরে যায়। প্রায় প্রতিবাদহীনভাবেই আমরা মেনে নেই এই হত্যাকাণ্ড।
অন্যদিকে গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যা করা হলো ফারুক হোসেনকে। এই সেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন প্রক্টর সামসুজ্জোহা। যিনি পাক-হানাদারদের প্রতি হুঙ্কার করে বলেছিল একটি ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে তার বুকে গুলি করতে হবে। তাকে গুলি করে তৎকালীন হানাদার-পাকবাহিনী। আর এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাজশাহী শহর আবরোধ করতে গিয়ে সেই দিন গুলিতে প্রাণ হারায় ছাত্র ইউনিয়ন রাজশাহী সিটি কলেজের নেতা নুরুল ইসলাম। কথাগুলো এজন্যই বলছি এই দুই বিদ্যাপিঠের রয়েছে রক্তদানের গৌরবোজ্জল ইতিহাস। আর আজ সেখানে কেবল অবমাননাকর, পচাঁ, দুর্গন্ধ আর নিষ্ঠুরতাময় ঘটনার আবাসভূমি। আমরা কি এমনটাই দেখতে চাই?
ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বেপরোয়া অবস্থান ও সন্ত্রাস: বর্তমান সরকার ক্ষমতার আসার পর থেকেই তাদের লাঠিয়াল বাহিনী ছাত্রলীগ সেই পুরানো রূপেই ফিরে যায়। কিন্তু এবার শুরু থেকেই তাদের প্রধান বৈশিষ্ঠ্য হিসেবে সংযুক্ত হয় টেন্ডারবাজি। এ পর্যন দেশব্যাপী যতগুলো সংঘাতময় ঘটনা ঘটেছে তার প্রধান কারণ হলো এই টেন্ডারবাজি ও তার ভাগ-বাটোয়ারা। এসরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র কয়েক মাস পরে ছাত্রলীগের জনৈক কেন্দ্রীয় নেতা খুব দম্ভ করেই বলছিলেন যে, সপ্তাহে যতি লাখ টাকা কামাতে নাই পারলাম তবে কেন্দ্রীয় নেতা কেন? একথা বললে বা না বললেই বা কি তাদের প্রতিদিনের কর্মসূচি থেকেই তা বুঝা যায়। বর্তমান ছাত্রলীগ সংগঠনের কর্মকাণ্ড ও নেতৃত্বের ভোগবাদি-সুবিধাবাদি চরিত্রের দিক থেকে ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের সাথে আমূল কোন পার্থক্য নেই। সার্বিকভাবে ছাত্র নামধারী একটি সংঘবদ্ধ লুটপাটকারীদের সংগঠন হিসেবে আজ তারা জাতির সামনে দাঁড়িয়ে। এক কথায় শিক্ষা ও ছাত্র স্বার্থের পক্ষে (আমরা যাকে ছাত্র আন্দোলন বলি ) তাদের কোন উদ্যোগ বা ভূমিকা নেই। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ ৯ মূলত এক পক্ষ) কে ভাগ-বাটোয়ারা থেকে দূরে রাখতেই তারা সন্ত্রাস হত্যাকান্ড ও দখলদারিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। লজ্জার বিষয় এসব দেখে (মূলত মিডিয়াকে দেখাতে) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের সাংগঠনিক পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন কিন্তু ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব ছাড়েনি। তাই এর কোন সহজ সমাধান নেই। এর সমাধান একটিই আদর্শবাদি রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আদর্শবাদি রাজনীতির কারণেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। আজ সেই সেই আদর্শহীন রাজনীতিকেই সম্বল করে ছাত্রলীগ ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। এই ছাত্রলীগের আদর্শ কি বঙ্গবন্ধু?
ছাত্রদল-ছাত্রশিবির ও তাদের আদর্শহীন ফ্যাসিবাদি ধারা: ছাত্রশিবির ইতিহাসের বেইমান ও বিশ্বানঘাতকদের উত্তরসূরি হিসেবে তার উগ্র সামপ্রদায়িক রাজনীতিকে ব্যবহার করছে এদেশের ছাত্র সমাজের উপর। ধর্মান্ধতা আর ক্থপমুন্ডকতা দ্বারা তারা এদেশের স্বাধীনতা আর বাঙালির অসামপ্রদায়িক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চায়। তারা সেই ,৭১ এ যে ভূমিকা পালন করেছিল আজো তারা একই ভূমিকা পালন করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধকে আজো তারা স্বীকৃতি দেয়না এবং তারা জঙ্গীবাদকে এবং আফগানিস্থানের মতো একটি রাষ্ট্র বানাতে তারা তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এবং স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি তারা ফ্যাসিবাদি কায়দায় তাদের হত্যা ও সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ছাত্রদল গঠিত হয়েছিল এদেশের মেধাবীদের ধ্বংস করার উদ্যেশ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদলের কমিটি গঠন করা হয় এবং যার সভাপতি নির্বাচন করা হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একজন পরাজিত প্রার্থীকে। যার বয়স ৪৭ বছর এবং তিনি বিবাহিত এবংকি তিনি সন্তানের জনক। তার পরিবারের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্ঠতার সুস্পষ্ট অভিযোগও রয়েছে। মূলত সেই একই সুবিধাবাদি ধারার রাজনীতিকেই তারা লালন করে থাকে।
সাম্প্রতিক কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের বিবাদমান দুগ্রুপের সংঘর্ষ এবং হানাহানি খবর আমরা প্রত্যেকেই জানি।
এখন প্রশ্ন হলো এই সংগঠনগুলো কি আদৌ কোন ছাত্র সংগঠন? এক কথায় যেকোন বিবেগবান মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তারা এক কথায় বলবেন, না। কারণ একটি ছাত্র সংগঠনের যে আদর্শ ও উদ্দেশ্য থাকা উচিত এই সংগঠনগুলোর মধ্যে তার কিছুই নেই। নূনতম সাংগঠনিক কাজ তাদের নেই। অন্যদিকে একের পর এক দ্বন্দ সংঘাত তাদের প্রাত্যহিক কাজ। ছাত্রদের মেধা ও মননকে তারা কোনভাবেই বিকশিত করার জন্য কোন প্রচেষ্ঠা তারা কখনই চালান না। ঠিক উল্টোটা মাদক,অস্ত্র, চাঁদাবাজি,ধর্ষণ এদের নিত্যদিনের কাজ। আর যখন এই কর্মকান্ডে কোন বাধা তৈরি হয় তারা তখনই বেপরোয়া হয়ে উঠে। এবং কি সুস্থ ধারার যেকোন ছাত্র আন্দোলনকে প্রতিহত করতেও তারা প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই এই ধারাকে যারা ছাত্র রাজনীতি বা আন্দোলন হিসেবে বিবেচনা করেন ,তারা আরেকবার ভেবে দেখবেনকি?
গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গভীর রাতে শিবিরের ক্যাডাররা নৃশংসভাবে হত্যা করে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুখ হোসেনকে। এবং এসময় আরো ৫০জনকে খুর,দা,কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে আহত করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুগ্রুপের সংঘর্ষের কারণে মারা যায় মেধাবী ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক। এসরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩ জন ছাত্রকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এখন প্রশ্ন হঠাৎ করে এই সকল সংগঠনগুলো একভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। এর পেছনে কি কোন রহস্য বিদ্যমান? হঠাৎ কেন এই হত্যা মিছিল ? মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এদেশের মানুষের একটি বড় চাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং এর সাথে সামপ্রদায়িক রাজনীতি আইন করে নিষিদ্ধ করা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে এবং সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়েছে। পাশাপাশি জণগন দেয়া প্রতিশ্রুতি হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি প্রধান বিষয় হিসেবে সামনে চলে এসেছে। তাই,৭২ এর সংবিধান পূনপ্রতিষ্ঠা, সামপ্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সহ বিভিন্ন বিষয়ে জনমত আজ উগ্র সামপ্রদায়িক দলগুলোর প্রধান সমস্যা। তাই দেশব্যাপী একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে তারা উদগ্রীব। তাইতো রাতের আধারকে আবারো তারা বেছে নিয়েছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। তাই এটা কোন সাধারণ ঘটনা নয় বরং এসকল ঘটনার ভেতরে লুকিয়ে আছে অনেক বড় ষড়যন্ত।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্মলগ্ন থেকে তার আদর্শের সংগ্রামকে সামনে রেখে লড়ে যাচ্ছে। মেধা এবং মননকে পুঁজি করে ছাত্র ইউনিয়ন এদেশের ছাত্র আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। একদিকে সামপ্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম , অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামকে সে ছড়িয়ে দিয়েছে। সকল লোভ লালসা ও সুবিধাবাদের বাইরে থেকে ছাত্র ইউনিয়ন আজো আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ। ছাত্র অধিকার আন্দোলনে এখনো আপোষহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সুস্থ ধারার প্রকৃত ছাত্র আন্দোলনকে বেগবান করতে হলে আজ ছাত্র ইউনিয়নকে শক্তিশালী করার কোন বিকল্প নেই। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আজ আবারো ছাত্র সমাজকে সাথে নিয়ে আরেকটি দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যারা ছাত্র অধিকার নিয়ে ভাবেনা তাদের চেহারা সাধারণ ছাত্রদের সামনে তুলে ধরতে হবে। আর ব্যাপক সংখ্যক ছাত্র সমাজের সামনে নিয়ে যেতে হবে ছাত্র ইউনিয়নের নীল পতাকাকে। জয় আমাদেরই হবে। কারণ আমরাই ছাত্র সমাজের প্রতিনিধিত্ব করি।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (২০১০-২০১২)
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন