শুক্রবার, ১৫ জুন, ২০১২

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি: অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকেনা

সত্যজিত দত্ত পুরকায়স্থ

উৎসর্গঃ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের লড়াকু সহযোদ্ধা বন্ধুদের।

.
১৮৩০ সালে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে জুলাই বিপ্লবের সম্পাদন কালে কলকাতার কয়েকজন ছাত্র এক গভীর রাতে নবনির্মিত অক্টরলনি মুনমেন্টের চুড়া থেকে ইংরেজদের পতাকা নামিয়ে উড়িয়ে দেয় ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার তেরংগা ঝান্ডা। এই ঘটনা পরবর্তীকালে এই উপমহাদেশের ছাত্রসমাজ কিংবা সার্বিক স্বাধীনতা আন্দোলনে কতটুকু ভুমিকা পালন করেছিল তা বলা একটু কঠিন। তবে এই ঘটনাকেই এই উপমহাদেশে ছাত্র আন্দোলনের আতুড় ঘর বলা চলে। পরবর্তীকালে কলকাতার হিন্দু কলেজের শিক্ষক হেনরী লুই ডিভিয়ান ডিরোজিও’এর হাত ধরে উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে যাত্রা শুরু করে উপমহাদেশের প্রথম ছাত্র সংগঠন “একাডেমিক এসোসিয়েশন”। এরপর ইয়াংবেংগল এবং তাদের পত্রিকা পার্থেনন এই উপমহাদেশের ছাত্র সমাজের রাজনৈতিক মনন বিকাশে অবদান রাখে।
.
সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন দলের অংগীভুত ছাত্র সংগঠনের ক্রিয়া কলাপের নিমিত্তে আমাদের কিছু নাগরিক ক্রিয়া কলাপের প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই লেখা। সাম্প্রতিক কর্মকান্ডের ফলে ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় ঐতিহ্য নিয়ে আর লিখলাম না, অনেকে নাখোশ হতে পারেন। একের পর এক ক্যাম্পাস অস্থির। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ছিল উচ্চ মনন এবং আগামীর নেতা তৈরীর, সেই বিশ্ববিদ্যালয় আজ ক্ষমতার পালা বদলে জন্ম দিচ্ছে লক্ষন সেন আর বখতিয়ার খলজীর। এক পক্ষ সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে আর অন্যরা পিছনের দরজা দিয়ে পালায়। সন্ত্রাসের অর্থনীতি, মনস্তত্ব, জনসংযোগ সবকিছুর কেন্দ্র এখন বিশ্ববিদ্যালয়। এক সময় ইউরোপের শক্তিমান দেশগুলো নিজেদের শক্তি পরীক্ষার জন্য তুর্কি খলিফার শাসনাধীন বলকান অঞ্চল কে বেছে নিত। এতে লাভ হতো এই যে, যুদ্ধে যে পক্ষই জয় লাভ করুক, নিজেদের দেশের লোকজন, শিল্প-বাণিজ্য যুদ্ধের মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি থেকে বেঁচে যেত। আজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন না কোন ভাবে আমাদের রাজনৈতিক দল সমূহের বহুপাক্ষিক শক্তি পরীক্ষার “বলকান অঞ্চল”। জাবিতে জুবায়ের হত্যাকান্ডসহ সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানেই তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে, ২০০৮-১০ এই সময়ে ক্যাম্পাসগুলোতে মোট সংঘাত ২৪২ টি, নিহত ১৬, আহত ৪ হাজারেরও বেশী, মোট ৮০ টি শিক্ষা প্রতিষ্টান বন্ধ। এখন আমরা যদি এর পিছনের কারণগুলো খুজে বের করবার চেষ্টা করি তাহলেই এর স্বরুপ আমাদের কাছে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে উঠে। এর পিছনের মূল কারণ বা নিয়ামক ক্ষমতাসীনদের সাথে আপোষহীন লেজুড়বৃত্তি, আহমদ ছফা ছাত্র রাজনীতিকে জাতীয় রাজনীতির শিশু শ্রমিক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু আমরা যদি “রাজনীতি” শব্দটির আভিধানিক অর্থ খুজে দেখি তাহলে আমরা পাই এর উদ্দেশ্য রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কার্যক্রম বা কর্মকান্ড। ফলে শাসক শ্রেণীর অগণতান্ত্রিক, ভোগবাদী, ফ্যাসিস্ট আচরন যে ছাত্র সমাজের মাঝেও সংক্রামিত হবে এটাই স্বাভাবিক। আমার মূল আলোচনা হলো আমাদের নাগরিক ভাবনার জায়গা নিয়ে, কারণ ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হলেও দিনশেষে ঐ জায়গাতে ফিরতে হয় কিনা তাই একে অস্বীকার করার বা এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নাই। কারণ যেই না ছাত্রলীগ আবার তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে মরিয়া (অন্তত সাতক্ষীরার দুই নেতার কাণ্ড-জাবি-জবি-বুয়েট-কুয়েট তাই বিশ্বাস করতে বলে) তখন আমাদের দেশের একদল প্রবীন এবং নবীন স্বমস্বরে উচ্চকন্ঠ “ছাত্র রাজনীতি বন্ধ কর”। এদের মাঝে কেউ বুঝে আর কেউ না বুঝে। তাইলে তো সবার বলা উচিত আমরা গত ৪০ বছরে জাতীয় রাজনীতিতে কি পেলাম? ক্ষমতার পালা বদলে কিছু ক্ষমতালোভী চোর-বাটপার-মুনাফা খোর ব্যাবসায়ী আর কমিশনখোর এই আমাদের প্রাপ্তির খোরা খাতা। তাইলে তো জাতীয় রাজনীতি সবার আগে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। তারচেয়ে বড় কথা আমরাই বারবার নানা অজুহাতে এদের ভোটের নামে নির্বাচিত করি, তার মানে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় গলদ আছে তাহলে আমাদের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত। আমাদের সবার আগে খুঁজে বের করা উচিত আমাদের জাতীয় রাজনীতির চরিত্র কেন বেপথে; কারণ নগর যখন পুড়ে দেবালয় কি তা এড়াতে পারে! যারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে চান তারা একটুও প্রশ্ন তুলেন না- কেন আমাদের দেশে এই তথাকথিত গণতন্ত্র এলো যার কারণে গত দুই যুগেরও বেশী সময় যাবৎ সকল ছাত্র সংসদ কার্যতঃ অকার্যকর। যেখানে লজ্জার কথা হলো স্বৈরাচারী এরশাদও দুইবার ডাকসু নির্বাচন দিয়েছিল! আমরা যে এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে পারলাম না, এর ফলে ক্ষতিটা আমাদেরই হলো। যেমন ধরা যাক গত ২০ বছরে যদি শুধুমাত্র ডাকসুতে ২০ টা নির্বাচন নিয়মিত হত তাহলে কমপক্ষে ২ জন করে হলেও ৪০ জন নেতা পেতাম, যারা আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে নেতার ভূমিকা পালন করতে পারত। যার ফলে কিন্তু এই শুণ্য জায়গা দখল করে বসল ব্যবসায়ীরা, যাদের কাছে তাদের রাজনৈতিক নেতার পরিচয় একচেটিয়া মুনাফা তৈরীর মেশিন।
.
সাম্প্রতিক সময়ের চলমান ক্যাম্পাস অস্থিরতায় উপাচার্য-প্রক্টরদের ভুমিকাও বেশ গুরত্বপূর্ণ বিবেচনার দাবী রাখে। মূলতঃ দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এই ভিসিরা চরম দলীয় কর্মীর মত আচরন করে যাচ্ছেন। জাবি, জবি, বুয়েট, কুয়েট বা চবি প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিগণ একই আচরন করছেন। জাবিতে তো ছাত্রলীগের ভিসি গ্রপের অস্ত্বিতই পাওয়া গেছে। থাকলো বাকি প্রক্টরদের কথা। তারাও বলিহারি, সবাই একই চরিত্রের। কেউ হুংকার ছাড়েন দেখে নেবেন বলে, কেউবা লাশের সামনে দাড়িয়ে সিগারেটের ধোয়া ছাড়েন। মাঝে মাঝে এদের আচরনে মনে হয় এরা ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের সভাপতি-সম্পাদক। তারা আজ নানা রঙ্গে অংগ সাজান কেউ লাল, কেউ নীল, কেউ বা হলুদ।
.
আমাদের নাগরিক ভাবনার জগতে মিডিয়া বিশেষত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রভাব বাড়ছে। এর উপযোগীতা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। বর্তমান সময়ে টিভি চ্যানেলগুলোর টক-শো যেগুলোর অধিকাংশ প্রচারিত হয় মাঝ রাতে, যখন বাংলাদেশ ঘুমিয়ে থেকে এবং এদের দু-একটা ছাড়া অনেক গুলোরই কোন সামাজিক উপযোগিতা আছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। সাম্প্রতিক ছাত্র রাজনীতির চলমান ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এই টক-শো গু্লোও এক ধরণের একপেষে আচরন করছে। কোন টক-শোতেই দেখলাম না এই ইস্যুতে সাম্প্রতিক সময়ের কোন নেতা বা সংগঠককে আনতে। যারা আসছেন তারা একসময় ছাত্র রাজনীতির অংশ ছিলেন। কিন্তু বির্তক বা আলোচনা হওয়া উচিত ছিল ক্রিয়াশীল নেতা কর্মীদের মধ্যে। আয়নার সামনে দাড় করানো উচিত সবাইকে।
.
তারপরেও আমরা আশাবাদী হতে পারি। তবে তারও ব্যতিক্রম আছে বিশেষতঃ বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আন্দোলন-সংগ্রামে সব সময় সক্রিয়। এছাড়াও বুয়েট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান ছাত্র আন্দোলন আমাদের আশাবাদী হতে বলে। আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ছাত্র আন্দোলনের গতিধারাটা দেখি। আন্দোলনের শুরু একটা রাজনৈতিক মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্র জোটের হাতে কিন্তু এখন তা সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা যুথবদ্ধতার প্রমাণ বহন করে। আর এতে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল কেন হামলা করে তাও স্পষ্ট, কারণ তারা আমাদের এই যুথবদ্ধতাকে ভয় পায়। আহমদ ছফার “ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত বিশ্ববিদ্যালয়” প্রবন্ধে তার করা প্রত্যাশাটাই আজ বড় বেশী প্রসঙ্গিক - এই রকম নিস্ফলা-বন্ধ্যা সময়েও আমি বিশ্বাস করি, ভুখন্ডের জনগোষ্ঠির প্রতি বিদ্যুতের অক্ষরে অমোঘ নির্দেশ জারি করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তেজিত হও, জাগ্রত হও, জ্ঞানের আলোকে জাগ, মানবতার আবেগে জাগ, প্রতিরোধের দুর্দম স্পৃহা বুকে নিয়ে নতুন পৃথিবী নির্মাণ করার প্রতিজ্ঞায় জাগ…”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন