২৬ এপ্রিল ২০১২
ছাত্র ইউনিয়ন’র ৬০তম প্রতিষ্ঠাবাষির্কী উপলক্ষে আয়োজিত আজকের এ উদ্বোধনী সমাবেশ থেকে দেশে ও প্রবাসে অবস্থানরত ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী, সমর্থক,
শুভানুধ্যায়ীসহ নীল পতাকার ৬ দশকের সুবৃহৎ পরিবারের সকল সদস্যকে বাংলাদেশ
ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ছাত্র
ইউনিয়ন-এর চেতনা ও আদর্শকে যাঁরা উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন সে সব বীর শহীদদের
শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। একই সাথে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, টংক আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ,
নানকার বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ এ অঞ্চলের এবং সারা পৃথিবীতে মানবমুক্তির
সংগ্রামে যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, সেসব মৃত্যুঞ্জয়ী লাখো শহীদদেরকে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যখন চুড়ান্তভাবে ধ্বসে পড়েছে, তখন শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অগ্রণী সংগঠন তার ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে। এদেশের শিক্ষা আজ শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু সুবিধাভোগী বিত্তবান শ্রেণির সন্তানদের জন্য সীমাবদ্ধ হয়ে আসছে। কাগজ কলমসহ শিক্ষা উপকরণের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষক-শ্রমিকের সন্তানরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ শিক্ষা কাঠামোর বাইরে থাকায় রাষ্ট্র হিসেবে আজও বাংলাদেশ তার মেধা
সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করতে পারছে না। রয়েছে স্কুল সঙ্কট, যেখানে স্কুল
আছে সেখানে ক্লাসরুম সঙ্কট, শিক্ষকের অভাব, লাইব্রেরির
অভাব, বিজ্ঞানাগারের অভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
শিক্ষার মান ও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের পাশাপাশি শিক্ষা সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা
পর্যন্ত যে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তাও জরাজীর্ণ। ঘুণেধারা এ
শিক্ষা কাঠামো সেজন্যই জাতির মানসিক গঠনে ভূমিকা রাখতে পারছে না, উপরন্তু বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়, অস্থিরতা। বহুবছর পর জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও তাতে জনগণের আশা আকাঙ্খার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেনি; বরং শিক্ষার বাণিজ্যিকীরণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আজকের এ সমাবেশ দাবি তুলছে, অবিলম্বে শিক্ষাখাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এর অবকাঠামো পুনঃনির্মাণসহ শিক্ষা উপকরণের দাম কমাতে হবে, শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের নুন্যতম ৮ ভাগ বরাদ্দ দিতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে হবে।
বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক ধারণার ওপর শিক্ষা না দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি সংস্থার ক্রমাগত ষড়যন্ত্রে শিক্ষা বাণিজ্যিকরূপ ধারণ করছে। বহুধাবিভক্ত শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমাগ্রিকভাবে বাণিজ্যনির্ভর কেনা-বেচার পণ্যে পরিণত করার চক্রান্ত চলছে। ফলে
গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাই আজ ধ্বংসের মুখে। কোচিং ব্যবসা, বেতন বৃদ্ধি,
নানানখাতে নতুন নতুন ফি নির্ধারণের মাধ্যমে একটি অসাধু চক্র শিক্ষাকে
ব্যবসায় পরিণত করছে। ইউজিসির কৌশলপত্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয়
বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছে। এর মাধ্যমে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা লুটপাটকারী শ্রেণির আরো বিত্তবান হয়ে ওঠার নিছক একটি মাধ্যমে পরিণত হবে। প্রায়
ক্ষয়ে যাওয়া জাতীয় মেরুদণ্ড একেবারেই নিঃশেষ হবে। পাশাপাশি শিক্ষাকে
সাম্প্রদায়িকীরণের অপচেষ্টাও বিদ্যবান। এ ষড়যন্ত্র, এ চক্রান্ত যে কোন
মূল্যে রুখে দাঁড়াতে হবে। তাই আজকের এ সমাবেশ থেকে জোর গলায় দাবি তুলছি
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ নিষিদ্ধ করতে হবে। একই ধারার গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
ইতিহাস বলে, এদেশের অগ্রযাত্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের রয়েছে গৌরদীপ্ত অবদান। কিন্তু সমাজ বদলের গতিশীল নেতৃত্ব বিকাশে শিক্ষাঙ্গনে গণতন্ত্র চর্চার দ্বার রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। নির্বাচিত ছাত্র সংসদের কার্যক্রম দশকের পর দশক ধরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া ছাত্র সমাজের সমস্যার যৌক্তিক কোন সমাধান সম্ভব নয়।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রা পশ্চাদগামী। সমাজে ক্রমাগত সমস্যা, সঙ্কট, অবক্ষয়, অধোগতির ধারা বেড়ে চলেছে। সাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদ, লুটপাটতন্ত্রের আক্রমণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ ভূলণ্ঠিত।
আত্মকেন্দ্রীকতা, প্রদর্শনবাদ, ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি, অপসংস্কৃতি, ভোগবাদ
ইত্যাদি সুস্থ মানবিক বোধ ও উন্নত সাংস্কৃতিক মননের বিকাশকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
এ অবস্থার অবসান জরুরী। নাগরিক নিরাপত্তায় ঔদাসীন্য, নতজানু
পররাষ্ট্রনীতি, সাংস্কৃতিক অবনমন, সর্বগ্রাসী ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিতে দেশ আজ
ভয়াবহ সঙ্কটের সম্মুখীন। ৭২’র সংবিধানের মূলভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা,
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি, জাতীয় সম্পদের উপর আত্মনিয়ন্ত্রণ,
সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ঘুরে দাঁড়ানোর এটাই উপযুক্ত সময়। ছাত্র ইউনিয়নের এই সমাবেশ থেকে ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা
ছাত্রসমস্যাভিত্তিক সকল আন্দোলনে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে ছাত্র আন্দোলনকে
অগ্রসর করছি। শিক্ষা ধ্বংসের যে কোন ষড়যন্ত্র সমস্ত শক্তি দিয়ে রুখে দেব।
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণের চক্রান্ত প্রতিহত করবো।
১. সর্বজনীন, গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক, একই ধারার সেক্যুলার শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় আয়ের ৮ ভাগ
শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে
হবে।
২. ৭২’র সংবিধানের মূলভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। যুদ্ধপরাধীদের বিচার ও সম্প্রদায়িক রাজনীতি আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।
৩. জাতীয় সম্পদের উপর আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হবে।
৪. জনগণের মুক্তি নিশ্চিত করতে দ্বি-দলীয় ধারার বিপরীতে বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে হবে।
সংগঠনের
৬ দশকে গড়ে উঠেছে আমাদের এক বিশাল পরিবার। এই পরিবারের সদস্যরা
ঐক্য-শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী,
অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের শপথে উদ্দীপ্ত, বিভিন্ন সময়কালে দীক্ষিত হওয়া ছাত্র ইউনিয়ন
পরিবারে লক্ষ-লক্ষ সদস্যবৃন্দ আসুন আজ আমরা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক
পরিবর্তনে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করি। মানবমুক্তির প্রত্যয়ে আসুন আমরা দৃঢ়
পদক্ষেপে অগ্রসর হই। শহীদদের স্বপ্নসাধ বাস্তবায়নে ব্রতী হই।
শহীদদের স্বপ্নসাধ বাস্তবায়নে আমরা আমাদের সংগ্রামকে অব্যাহত রাখব।
শহীদদের স্বপ্নসাধ বাস্তবায়নে আমরা আমাদের সংগ্রামকে অব্যাহত রাখব।
শহীদদের স্বপ্নসাধ বাস্তবায়নে আমরা আমাদের সংগ্রামকে অব্যাহত রাখব।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
জিন্দাবাদ।
এস এম শুভ
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
সদস্যসচিব, ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন